লগ ইন
 

Logo

Social and Cultural Development Foundation (SCDF) এর তথ্য সমূহ

হামার দিনাজপুরের হিস্টোরী

দিনাজপুর এর ইতিহাস
(প্রসঙ্গঃ নামকরণ, শাসনামল ও ঐতিহাসিক স্থাপত্যের, প্রত্মতাত্মিক ধ্বংসাবেশ ও সংরক্ষণ এবং শিল্প ব্যবস্থা)

- আহসান হাবিব সাজু

ভৌগলিক দিক থেকে উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রভূমির উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত দিনাজপুর জেলা যেমন প্রাচীন, ইতিহাসের দিক থেকেও তেমনি প্রাচীন। দিনাজপুর শহর হতে কান্তনগর পর্যন্ত ভূখন্ডটি জেলার সর্ব উচ্চ স্থান।
১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক দেওয়ানি লাভের সময়কালে সুবা বাঙলা কমপক্ষে ২৮টি জেলায় বিভক্ত হয় এবং সুবা বাঙালার এই জেলাওয়ারি বিভাগ মির কাসিম দ্বারা প্রবর্তিত হয়। দিনাজপুরের নাম এর মধ্যে পাওয়া যায়। উল্লেখ্য ১৭২২ হতে ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে দিনাজপুর নামের প্রচলন হয়। 
মুর্শিদকুলি খান (১৭০৪-১৭২৭ খ্রীঃ) বাংলা সুবাকে ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করে যে নতুন প্রশাসনিক বিন্যাস করেন তাতেও দিনাজপুর বলে কোন মহাল বা পরগনার নাম পাওয়া যায় না। তবে দিনাজপুরের অধিকাংশ এলাকা আকবরনগর ও চাকলা ঘোড়াঘাটের অর্ন্তভূক্ত ছিল। উল্লেখ্য দিনাজপুর জমিদারী অধিকৃত অঞ্চলে দিনাজপুর নামে কোন মহাল বা পরগনা বা মৌজার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। দিনাজপুরে জমিদারীর উৎপত্তি সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা আজও কোন সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। একটি প্রচলিত কিংবদন্তি মতে দেবী কিংদন ঘোষ রংপুরের বর্ধনকুটির রাজা আর্যাবরের কর্মচারী ছিলেন। তার পুত্র হরিরাম নামান্তরে (দিনওয়াজ) রাজা গণেশের কর্মচারী ছিলেন। রাজা গণেশের মৃত্যু হলে দিনওয়াজ গণেশপুত্র যদু নারায়নের পেশকার নিযুক্ত হন। এর পর যদু ইসলাম ধর্ম গ্রহন করলে মনের দুখে দিনওয়াজ চাকুরীতে ইস্তেফা দিয়ে উত্তরবঙ্গে চলে আসেন এবং সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। সেখানে তার নামানুসারে উক্ত জায়গার নাম দিনাজপুর হয়। বিস্তারিত অর্থে বলা হয় দিনাজপুরের নামের উৎপত্তি থেকেই দিনাজপুরে জমিদারী ও পরবর্তীতে দিনাজপুর জেলার সৃষ্টি হয়। যখন মুর্শিদকুলি খান কর্তৃক সুবা বাংলায় জমিদারী ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, সে সময় তিনি দিনাজপুরের জমিদার হিসাবে জমিদারী সনদ প্রাপ্ত হন। আর তখন থেকে দিনাজপুর নামের প্রচলনটা গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। দিনাজপুরের জমিদার সেসময় রাজা নামেও অভিহিত হতেন এবং যে অঞ্চলের জমিদারী প্রাপ্ত হন সে অঞ্চলের নাম অন্য কোন নামে নয়, দিনাজপুর নামে পরিচিত হতো। অনুমান করা যাচ্ছে যে, আটারো শতকের দ্বিতীয় দশকে দিনাজপুর নামের প্রচলন শুরু হয়। দেওয়ানি শাসনামলের শুরুতে দিনাজপুর জেলার আয়তন খুব বড় ছিল না বলে মীর কাশিমের আমলে জমিদারদের চাপের মুখে থাকতে হতো। নবাবি আমল বিলুপ্তির পর দেওয়ানি শাসনামলে দিনাজপুরের রাজা তার জমিদারীর আয়তন বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হন। যারফলে পার্শ্ববর্তী বিছিন্ন কিছু কিছু অঞ্চলগুলো জমিদারের অর্ন্তভূক্ত হয়। জেমস্ রেনেলের বিবরণ অনুযায়ী ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুরের আয়তন ছিল ৩,৫১৯ বর্গমাইল। রেনেলের বিবরণের পর বুকানন হ্যামিল্টনের বিবরণে জানা যায় যে, দিনাজপুরের আয়তন ক্রমশই বৃদ্ধি পেয়েছিল যা ওয়াল্টার হ্যামিল্টনের মন্তব্যে জানা যায়। স্থায়ী বন্দোবস্ত করা কালে দিনাজপুরের আয়তন ক্রমশই বৃদ্ধি হতে থাকে। ইদ্রকপুর জেলার প্রায় সমগ্র জেলা, শিলবাড়ী বা শালবাড়ী জেলার কিছু অংশ এবং মালদহ জেলার অধিকাংশ দিনাজপুরের অন্তর্ভূক্ত হয়। বুকানন হ্যামিল্টনের জরিপ অনুযায়ী আয়তনের পরিমান ছিল ৫,৩৭৪ বর্গমাইল। সে সময় উত্তরবঙ্গের এটাই সর্ববৃহৎ জেলা ছিল। বুকানন হ্যামিল্টনের উদ্ধৃতি অনুসারে রাজা দনুজ এর অধিকারভূক্ত অঞ্চল দিনাজপুর নামে পরিচিতি লাভ করে। সেই প্রাচীন যুগে দিনাজপুর সমেত সমগ্র উত্তরবঙ্গ ‘পন্ড্রুবর্ধন’ ভূক্তি নামে পরিচিত। দিনাজপুরে প্রবাহিত তিনটি প্রধান নদী প্রাচীন কাল হতেই প্রসিদ্ধ। নদী তিনটি করতোয়া, আত্রাই ও পূণর্ভবা নদী। করতোয়া নদীর কথা মহাভারতে পাওয়া গেছে। পুরাণ ও তান্ত্রিক গ্রন্থেও করতোয়া নদীর মাহাত্ম বর্ণনা করা হয়েছে। কামাখ্যাতন্ত্রে আত্রাই নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়। রেনেলের মানচিত্রে আত্রাই নদীকে তিস্তা নদীর সর্ববৃহৎ জলধারা হিসেবে দেখানো হয় এবং এই আত্রাই নদীর তীরে বর্তমান দিনাজপুর শহর অবস্থিত। দিনাজপুরের তৃতীয় উল্লেখযোগ্য নদী পূণর্ভবা নদী। এই নদী সম্পর্কে প্রাচীন শাস্ত্রীয় গ্রন্থসমূহে উল্লেখ দেখা যায়। প্রাচীন কোটিবর্ষ নগরী পূণর্ভবা নদীর পূর্বতীরে অবস্থিত। রেনেলের সময়কালীন মন্তব্যে জানা যায় আত্রাই ও পূণর্ভবা উভয় নদীই বছরের সবটুকু সময় নৌপরিবহন ব্যবস্থা চালু ছিল।
উল্লেখযোগ্য এই তিনটি নদী ব্যাতীত বেশ কয়েকটি ছোট ছোট নদী যেগুলো দিনাজপুর জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জেলাকে শস্য শ্যামলা করে সমৃদ্ধ করেছে। এই নদীগুলোর তীরে প্রাচীন কালে বৌদ্ধ বিহার, হিন্দু মন্দির এবং স্থানীয় শাসন কেন্দ্র নির্মিত হয়। এই ছোট নদীগুলো নাগর, কুলিক, টাঙ্গন, চিরা বা চিরামতি ,ঢেপা, গভুড়া বা গর্ভেশ্বরী, যমুনা ইত্যাদি।
দিনাজপুর জেলার জনবসতির ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের অনেক জেলা অপেক্ষা কম। উল্লেখ্য জেলার সর্বত্রই জনবসতি এক রকম নয় এবং প্রধান নদীসমূহের তীরবর্তী সমতল ভূমিতে জনবসতি অপেক্ষাকৃত বেশী। ধারনা করা যাচ্ছে যে, প্রগৌতিকহাসিক যুগে উত্তর হিমালয় পাদদেশের সংলগ্ন অঞ্চলের মোঙ্গল জাতির বসতি দিনাজপুর জেলার উত্তরাঞ্চলে বিস্তৃত ছিল। প্রাচীনযুগে দিনাজপুর জেলার ইতিহাসে প্রধান উপাদান দিনাজপুর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিভিন্ন রাজবংশের শাসনামলে উৎকীর্ণ তাম্রশাসন, সাহিত্য ও শাস্ত্রীয় রচনাবলী পুরাকীর্তির ধ্বংসাবেশ এবং বিদেশী পর্যটকের ভ্রমন কাহিনী প্রাপ্ত হয়। জেলার বিভিন্ন স্থানে রাজন্যবর্গ কর্তৃক উৎকীর্ণ তাম্রলিপি ও শিলালিপি পাওয়া গেছে। যা থেকে জেলার পুরাকীর্তির অনেক নিদের্শন এবং হাজার হাজার দেবমূর্তি আবিষ্কার হয়। দিনাজপুর জেলায় আবিষ্কৃত প্রাচীন লিপিতে উল্লেখযোগ্য গ্রামের নামসমূহ প্রগৌতিহাসিক যুগের বসতি সম্পর্কে প্রমান করে।
কালের করালগ্রাসে দিনাজপুর জেলার প্রগৌতিহাসিক সংস্কৃতির নিদর্শন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দিনাজপুর হতে প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শনসমূহ বেশীরভাগই দিনাজপুর রাজবাড়ি, কলকাতা জাতীয় জাদুঘর এবং আশুতোষ মিউজিয়াম , রাজশাহী বরেন্দ্র মিউজিয়াম এবং ঢাকা মিউজিয়ামে সংগ্রহীত রয়েছে। দিনাজপুরের রাজবাড়ীতে সংরক্ষিত নিদর্শনসমূহ পরবর্তীতে ঢাকা মিউজিয়ামে , সোনারগাঁও জাদুঘর ইত্যাদিতে স্থানান্তর করা হয়। দিনাজপুর জেলার প্রাচীন যুগের সংস্কৃতি, ধর্ম, স্থাপত্য শিল্প ও ভাস্কর্য শিল্প ইত্যাদি পুরাকীর্তির অবদান অপরিসীম। 
মোঙ্গল জাতির গোষ্ঠিসমূহ হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলের অরণ্যভূমিতে পিছু হাঁটতে বাধ্য হয়, যখন দক্ষিন হতে বাঙালী জাতির সম্প্রসারণ হয়। 
প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে শক্তিশালি জাতি পুন্ড্রুরা উত্তরবাংলায় আর্যসভ্যতা বিস্তারের বহু পূর্বেই এ অঞ্চলে বিস্তার করেছিল। কালের গর্ভে পুন্ড্রুদের মাঝে আর্যসংস্কৃতি লাভ করতে শুরু হয়। তখন পূণর্ভবা, মহানন্দা, আত্রাই, করতোয়া ইত্যাদি নদী পবিত্র নদী হিসেবে অভিহিত হয়েছিল। তাই এসব নদীর তীরে অনেক তীর্থস্থান গড়ে ওঠে। বৈদিক, বৌদ্ধ এবং জৈন এই তিনটি ধর্ম এবং এর শাখা প্রশাখা দিনাজপুর জেলায় বিস্তার লাভ করে যারফলে দিনাজপুর জেলায় আর্যসভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। 
বিখ্যাত প্রত্নতাত্মিক আলেকজান্ডার কানিংহোম দেবী কোর্ট প্রত্নতাত্মিক বর্ণনা হিসেবে বলেছেন কোটিবর্ষ বা বানগড়ের বহু পুরাকীর্তি দিনাজপুর রাজবাড়ীর শোভাবর্ধনে ব্যবহার করা হয়েছিল। দেবীকোর্ট দূর্গ বা দেব কোর্ট সুলতানী আমলের সূচনালগ্নে কোটিবর্ষের পরিবর্তে অধিক প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। হান্টারের বর্ণনায় দেবীকোর্ট দিনাজপুরের অর্ন্তগত একটি বৃহৎ রাজস্বভূখন্ড হিসেবে উল্লেখিত রয়েছে।
রামচরিত কাব্যে বরেন্দ্রভূমিকে পাল রাজাদের আদিপুরুষদের ভূখন্ড বলা হয়েছে, তাই দিনাজপুর জেলার একাংশ রাজা গোপালের অধীন ছিল। পাল শাসনামলে দিনাজপুর জেলা সামগ্রিকভাবে হোক কিংবা আংশিকভাবে হোক পাল রাজাদের রাজ্যের অধীন ছিল। গোপালের পুত্র মহারাজাধিরাজ ধর্মপাল একজন দিগ্বিজয়ী নরপতি ছিলেন। তিনি উত্তর ভারতের এক বিস্তৃত ভূখন্ডের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং দিনাজপুর সমেত সমগ্র উত্তরবঙ্গ নিজ রাজ্যের অধীন করেছিলেন। এভাবে এক এক করে পাল রাজাদের রাজত্বকাল অতিবাহিত হয়। মদন পাল দেবই পাল রাজবংশের সর্বশেষ নরপতি। তার রাজত্বের তাম্রশাসনটি আট বর্ষে উৎকীর্ণ হওয়ায় মনে হয় তিনি প্রায় নয় বছর রাজত্ব করেছিলেন। 
পাল শাসন মোটেই উপদ্রবপূর্ণ ছিলনা। উত্তর ভারতের উচ্চাভিলাসী রাজন্যবর্গের আক্রমন ও প্রতিবেশী রাজ্যসমূহের সামরিক অভিযানে পালরাজ্য প্রায় সময়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়তো। বহুবার রাজধানী পরিবর্তের কারনটি তার উল্লেখযোগ্য প্রমান। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অস্থিরতার প্রভাব দিনাজপুর জেলায় পড়েছিল। পালরাজ্যের সাথে দিনাজপুর জেলা দৃঢ়ভাবে সংবদ্ধ ছিল বলে প্রকৃত অর্থে এ জেলা ভিত্তিস্বরুপ ছিল। পাল শাসনামলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি দিনাজপুর জেলায় অধিক পরিমানে বিকাশ লাভ করেছিল।
জেলার পার্বতীপুর, বোচাগঞ্জ ও খানসামা অন্তর্গত গোয়ালদিহি স্থানে বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়।
দিনাজপুর জেলার ঐতিহাসিক নিদর্শনস্বরুপ স্থাপত্য ও দৃষ্টান্তের উল্লেখ করতে বলা যায় কান্তজিউ মন্দির, রামসাগর দীঘি ও রাজবাড়ির কথা । এছাড়াও ছোট বড় অনেক মন্দির, দীঘি, বিনোদনের জন্য বনভোজন স্থান, সংস্কৃতি ও ভাষাসহ প্রত্নতাত্মিক প্রাচীনকালের ধ্বংসাবশেষর ইতিহাস উল্লেখ করা যায়। এ ছাড়াও ফুলবাড়ী উপজেলার বামনগড়, দিনাজপুর শহরের দক্ষিন-পূর্বে ভগবানগঞ্জ নামক গ্রামে ফুলবাড়ীর নিকটে পুকুরি নামক স্থানে ও চরকাই অঞ্চলে বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। হিলি স্টেশনের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বৈগ্রাম নামক গ্রামে গুপ্ত যুগের তাম্রলিপি পাওয়া যায়। হিলি ও ঘোড়াঘাটের প্রায় মধ্যস্থলে অবস্থিত বেলওয়া নামক গ্রামে বহু প্রত্নতাত্মিক নিদর্শন ও পাল যুগের তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছে। 
বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার কান্তনগরে দিনাজপুরের মহারাজা প্রাননাথ অতি প্রাচীন একটি হিন্দুদের মন্দির স্থাপত্য করেছিলেন। যা বাংলাদেশের টেরাকোট্টা স্থাপত্যের একটি অহংকার করার মত নিদর্শন। যার নয়টি চূড়া বা শিখর ছিল কিন্তু ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ভূমিকম্পে শিখরগুলি ধ্বংস হয়ে যায়। 
দিনাজপুর শহরের ২১ কিলোমিটার উত্তরে কান্তনগরের ঢেপা নদীর তীরে কান্তজিউ মন্দিরটি অবস্থিত। সেখানে একটি ধ্বংস প্রাপ্ত শিবমন্দির ও তার সংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া বিশাল দীঘি দেখা যায়। এই কান্তজিউ মন্দিরটি বাংলাদেশ ও ভারতের মন্দিরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও নয়নাভিরাম মন্দির, যার গাত্রময় পোড়ামাটির অলংকরণে একমাত্র মন্দির স্থাপত্য। আজও প্রাচীনরুপে ঐতিহাসিক অনবদ্য এক মন্দির হিসেবে সগর্বে দাড়িয়ে রয়েছে। মন্দিরে গায়ে সারি সারি যেভাবে পোড়ামাটির কারুকার্যে বিষয়ভিত্তিক ভাবনা স্থান পেয়েছে তা প্রায় সবগুলো প্রামান্য দলিলরুপে বর্তমান লেখক গ্রন্থে সচিত্র লিপিবদ্ধ করেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের বিশেষ করে দিনাজপুর অঞ্চলের জীবন কাহিনীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় বহন করে আসছে মন্দিরটি। এ পরিচয় দিতে গিয়ে মন্দিরের গায়ের কয়েকটি পোড়ামাটির ফলক উদাহরণ স্বরুপ ব্যবহার করা হয়েছে। ফলকে তা ভাববঞ্জ্যক চরিত্রাবলীর সন্ধান মেলে। ১৭০২ অথবা ১৭০৪ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুরের রাজবংশের রাজা প্রাণনাথ (১৬৮২-১৭২২) নির্মান কাজ শুরু করে এবং নির্মান কাজ শেষ হয় ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে। সে সময় রাজা প্রাণনাথের পুত্র রাজা রামনাথ ক্ষমতায় থেকে রাজত্ব করেন। জানা যায়, এ অঞ্চলে বিরাট নামে এক শক্তিধর রাজা ছিলেন। তারই দূর্গের ধ্বংসাবশেষের উপর কান্তজিউ মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। মন্দিরটি প্রায় ০৩ বর্গ কিলোমিটার স্থান জুড়ে বিস্তৃত ও চারিদিক সুউচ্চ ও প্রশস্ত দূর্গ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। দূর্গের ভিতরে বেশ কয়েকটি বড় ঢিবি রয়েছে। ঢিবিগুলো সম্ভবত পুরাতন ইমারতের স্থান ছাড়া অন্য কিছু নয়। কান্তজিউ মন্দিরটি নবরত্ন মন্দির স্থাপত্যরীতির মত এবং ৯টি শিখর সম্বলিত। এ মন্দিরটি ইটে নির্মিত পিরামিড আকৃতির ধাপ বিশিষ্ট বর্গাকার ৩ তলা ইমারত। প্রথম তলা ৯.১৪ মিটার, দ্বিতীয় তলা ৬.১ মিটার এবং তৃতীয় তলা ৪.৫৭ মিটার উচু। প্রথম তলায় চার কোনে চারটি, দ্বিতীয় তলায় চার কোনে চারটি ও তৃতীয় তলায় মধ্যকুঠুরীর উপরে মাঝখানে একটি সর্বমোট ৯টি শিখর রয়েছে। বর্তমানে নবম চূড়ায় ধাতুনির্মিত ৩.০ মিটার বড় পতাকার মত যে শোভা পাচ্ছে তা রথ বিশেষ ইমারতের উচ্চতা নির্ধারন করছে। 
মন্দিরের গাত্র বা দেয়ালে ধাপে ধাপে সাজানো পোড়ামাটির নকশাগুলো অঙ্গ আভরনে পোড়ামাটির ফলককে বোঝায়। বিষয়ের প্রতি লক্ষ রেখে উৎকীর্ণ পোড়ামাটির ফলকগুলোকে ৫ ভাগে ভাগ করা যায় যেমন-
ক) হিন্দু মহাকাব্য রামায়ন ও মহাভারতের কাহিনী বিষয়ক
খ) ভগবান কৃষ্ণের রাসমন্ডলসহ তার সখী রাধার রসরঙ্গ
গ) হিন্দু পুরানের দেবদেবী বৃন্দ
ঘ) সমকালীন জীবনালেখ্য
ঙ) গোলাপ এবং অন্যান্য ফুলের সমারহ
এ বাদেও রয়েছে সমসাময়িক সমাজ জীবনের কাহিনী বর্ণিত : সেখানে দেখা যাচ্ছে একজন অভিজাত ব্যক্তি তার অধীনস্থ ব্যক্তি বা একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী সুসজ্জিত পাল্কী চড়ে সদলবলে ভ্রমন করছেন। পালকীতে ৬ জন বেহারাকে দেখা যাচ্ছে সঙ্গে ঘোড়ায় চড়া একজন শান্তিরক্ষক। তাকে অনুসরন করছে উট আরোহী ও বর্শা হাতে পদচারী। পালকীর নিচে দেখা যাচ্ছে একজন বংশীবাদক, পেছনে একটি কুকুর ছুটে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে সুন্দর এক দৃশ্য। যে সব সাধারন মানুষ দেখা যাচ্ছে তারা নারী-পুরুষ উভয় লিঙ্গের। পদাতিক কাহিনী, পাহারাদার, নৌকার মাঝি, সাহায্যকারী ও দিনমজুর ইত্যাদি যারা, তারা সাধারন খেটে খাওয়া মানুষ। শিল্পী আঁকা পাখি, ময়ুর, মোরগ, হাঁস ইত্যাদি ছাড়াও পশু বা অন্যান্য প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে- গন্ডার, ঘোড়া, ছাগল, মহিষ, বন্য শুকর, কুকুর, সাপ, উট, হাতি, বানর, সিংহ, শিংযুক্ত হরিণ ও গরু প্রভৃতি।
৩ রকমের নৌকা যেমন- ছিপ নৌকা, যোদ্ধার নৌকা ও মালবাহী সাধারন নৌকা। দিনাজপুরের শাসকবর্গ ও অভিজাত মানুষ মোঘল পোষাক পড়তে অভ্যস্ত ছিলেন এবং ইউরোপিয় পোষাকে একজন মানুষকে একজন পদাতিক মোঘল পোষাকধারী সৈন্যের সহযোগিতায় হাতিতে উঠতে দেখা যাওয়ার দৃশ্য দেখে, তা প্রতীয়মান হচ্ছে।
দিনাজপুর জেলার সদর উপজেলাধীন তাজপুর গ্রামে ৮ কিলোমিটার দক্ষিনে অবস্থিত মানুষ তৈরী একটি বিশালাকার দীঘি যার নাম রামসাগর। দীঘি পাড় সংলগ্ন একটি অতি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবেশ দেখা যায়। মন্দিরের নির্মান শৈলী অত্যন্ত সুন্দর এবং মন্দিরের গাত্রে পোড়ামাটির ফলকে অলং&কৃত ছিল। মন্দিরটি সংস্কার করা হলে পাল যুগের নির্মাণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যাবে। রামসাগরের উত্তর-দক্ষিনে দৈর্ঘ্য ১,০৭৯ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রস্থ ১৯২.৬ মিটার। ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগে মহারাজা রামনাথের শাসনামলে তৈরী এই দীঘি। মহারাজা রামনাথের নামে নামকরণ করা হয় এই বিশালাকার দিঘীর। সে আমলে প্রায় ৩০(ত্রিশ) লক্ষ টাকা ব্যয়ে ১৫(পনের) হাজার শ্রমিকের অংশগ্রহনের মাধ্যমে তৈরী হয় এই রামসাগর প্রকল্পটি। বনভোজন করার মত সুন্দর এক পরিবেশ ও পর্যটকগণের পরিদর্শন যোগ্য একটি ঐতিহাসিক বিশাল দীঘি রামসাগর। 
দিনাজপুর রাজবাড়ি সমন্ধে ইতিহাস বর্ণনায় বলতে হয়, ইতিহাস বলছে ‘দিনাজ’ বা ‘দিনোরাজ’ দিনাজপুর রাজবাড়ির নির্মাতা। অন্যভাবে বলা হচ্ছে যে, অন্যায়ভাবে ক্ষমতার অধিকার দখল করে ইলিয়াস আলী রাজত্ব করেন। কিন্তু সুপরিচিত রাজা গণেশ পঞ্চদশ শতাদ্বীর পূর্বে সত্যিকার অর্থে রাজবাড়ি স্থাপত্য করেন। সপ্তদশ শতাব্দির শেষ দিকে শ্রীমন্ত দত্ত চৌধুরী দিনাজপুরের জমিদার হয়েছিলেন তারপর তার বোনের ছেলে সুকদেব ঘোষ উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদার শ্রীমন্তের পুত্রের অকাল মৃত্যুতে প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
আর একটি কিংবদন্তি হচ্ছে দিনাজপুর রাজবংশ ভাতুরিয়ার জমিদার রাজা গণেশের বংশধর। এ গণেশেই পরবর্তীতে বাংলার সিংহাসন দখল করেন। অনেকে আবার রাজা গণেশকে অন্যতম ‘‘বারভূইয়া’’ বলে অভিহিত করেছেন। আরেক সূত্রে জানা যায় যে, রাজা গণেশ দনুজমর্দন নাম নিয়ে দিনাজপুরে বসবাস করতেন বলে জায়গাটি ’দনুজপুর’ নামে অভিহিত ছিল যা পরবর্তীকালে দিনাজপুর নামে পরিবর্তিত হয়। তার জৈনক বংশধর শ্রীমন্ত দ্ত্ত এবং তার পুত্র রাজা শুকদেব থেকেই দিনাজপুর রাজবংশের উৎপত্তি। দিনাজপুর জমিদার বংশের সাথে রাজা গণেশের কোন সম্পর্ক রয়েছে এ তথ্য মানতে অনেকেই রাজি নন, বিশেষভাবে দিনাজপুর রাজবংশের গ্রন্থকার মেহরাব আলী ও খ্যাতনামা প্রত্নতত্ত্ববিদ আ.কা.ম যাকারিয়া। মেহরাব আলীর মতে কাশী নামক জৈনক ব্রক্ষচারী ভক্তদের দানে অগাধ সম্পত্তির মালিক হন এবং কালক্রমে ষোড়শ শতকের শেষে ক্রয় সূত্রে দিনাজপুর জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পুত্রহীন অবস্থায় মারা গেলে তার শিষ্য শ্রীমন্ত দত্ত উক্ত জমিদারীর মালিক হন। শ্রীমন্ত দত্ত নিঃসন্তান ছিলেন ফলে তার (ব্রক্ষচারী কাশি) মেয়ে লিলাবতীর সাথে বর্ধনকুটির রাজা ভগবান দত্তের জৈনক উত্তারাধিকারী হরিরামের বিবাহ হলে পুত্র শুকদেব থেকেই দিনাজপুর জমিদার বংশের উৎপত্তি। তিনি সুদির্ঘ ৩৭ বছর রাজ্য শাসনের পর ১৬৭৭ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান এবং ১৬৮২ খ্রিষ্টাব্দে তার অন্যতম পুত্র রাজা প্রাণনাথ জমিদার হন। 
দিনাজপুর জমিদারী সম্রাট আকবরের রাজত্বে একবারে শেষদিকের (১৬০০খৃঃ) উদ্ভব। যে সময় বাংলা সুবায় ২৪টি সরকারের ৬টি সরকার নিয়ে গঠিত ছিল দিনাজপুর জমিদারী যা দিনাজপুর ও মালদহ জেলার অর্ন্তগত ছিল। এ জমিদারী প্রাননাথ (১৬৮২-১৭২২) আওরঙ্গজেবের আমলে বন্দোবস্ত পান তখন তার আয়তন ছিল ৮৯ পরগণা। অবশ্য কাগজপত্রের অভাবে উক্ত পরগণাসমূহের আয়তন নির্ণয় করা সঠিকভাবে সম্ভব হয়নি। তখন দিনাজপুর জমিদারী কোন একক জমিদারী ছিল না এবং নামও দিনাজপুর ছিল বলে মনে হয় না। মুর্শিদকুলি খানের সময় তের চাকলায় বিভক্ত বাংলার কোন চাকলার নামও দিনাজপুর ছিল না। তবে তার ‘‘মালজামিনী’’ প্রথায় বাংলার জমিদারী সমূহ নতুনভাবে বিন্যাস করা হলে সে সময় থেকেই দিনাজপুর নামে প্রচলন হয় দিনাজপুর জমিদারী এবং দিনাজপুর জমিদারও রাজা উপাধি লাভ করেন। আবার অনেকের মতে ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে কোম্পানী শাসনভার গ্রহণের সময় বাংলা সুবা ২৮টি জেলায় বিভক্ত হয় এবং অন্যতম জেলা হিসাবে দিনাজপুরের নাম পাওয়া যায়। সুতরাং ১৭২২ থেকে ১৭৬০ এর মধ্যবর্তী সময়ে দিনাজপুর নামের প্রচলন হয়। তখন দিনাজপুর জেলা ১২১টি পরগণা নিয়ে গঠিত ছিল এবং আয়তন ছিল ২১১৯ বর্গমাইল। এরপর কোম্পানী শাসনভার গ্রহণের পর থেকে বিশেষ করে ১৭৮৪ সালের পর থেকে দিনাজপুর জেলার আয়তনের এক স্থিতিশীল চিত্র পাওয়া যায়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আগে পর্যন্ত বর্তমানে মালদহ, বগুড়া ও রাজশাহী জেলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল দিনাজপুর জেলা। এর পশ্চিম সীমানা মহানন্দা নদীর পূর্বাঞ্চল থেকে শুরু করে দক্ষিন সীমানা রোহনপুরের কাছে মহানন্দা পূণর্ভবার মিলনস্থান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রকৃতপক্ষে ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাগজপত্রে দিনাজপুর জেলার সঠিক আয়তন নিরুপিত হয়। ১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দে হ্যামিলটন বুকাননের বিবরণ থেকে অত্র জেলার যে আয়তন পাওয়া যায় তাতে তার পরিমান ছিল ৫৩৭৪ বর্গমাইল। এটি ছিল দিনাজপুর জেলার সর্ববৃহৎ আয়তন। অপরদিকে রাজস্ব ইউনিট হিসেবে দিনাজপুর জমিদারী কোম্পানীর দুর্বৃত্তায়নের ফলে রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হতে থাকে এবং ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে নাবালক রাজা রাধানাথের (১৭৯২-১৮০১) মৃত্যুর পর সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়ে। অল্প কিছু পরগণা ছাড়া দেনার দায়ে দিনাজপুর জমিদারীর লাভজনক পরগণাসমূহ বিক্রি হয়ে বহু ছোট ছোট জমিদারীর উদ্ভব হয়। অতঃপর ১৮০১ থেকে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত দিনাজপুর জমিদারী চারজন রাজা শাসন করলেও দিনাজপুর জমিদারী আর সাবেক আয়তনে ফিরে আসেনি। ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে রেভিনিউ সার্ভেয়ার মেজর শেরউইলের বিবরণীতে দিনাজপুর জেলার আয়তন নিরুপিত হয় ৪৫৮৩ বর্গমাইল। 
১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম আদম শুমারীর কমিশনার মিঃ বেলাভির রিপোর্ট অনুযায়ী দিনাজপুর ৪১৪২ বর্গমাইলে ১৮,০১,৯২৪ লোকসংখ্যার এক জেলায় উপনীত হয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৭০ পর্যন্ত বগুড়া ও মালদহ জেলা সৃষ্টি হওয়ার ফলে দিনাজপুর জেলার আয়তন কমতে থাকে এবং বিংশ শতাব্দীর সূচনায় ১৫,৬৭,০৮০ লোকসংখ্যায় ৩৯৪৬ বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট একটি জেলায় পরিণত হয়।
দিনাজপুর জেলায় প্রথম মহকুমা বিভক্তি হয় ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে যখন ঠাকুরগাঁও মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং ৭ বছর উক্ত মহকুমা বজায় থাকে। ২০ বছর পর অর্থ্যাৎ ১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুর জেলার উত্তরাংশ নিয়ে আবার ঠাকুরগাঁও মহকুমা প্রতিষ্ঠা হয় এবং বাকি জেলা ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে গঙ্গারামপুর, পোরশা, পত্নীতলা, ফুলবাড়ী নিয়ে বালুরঘাট মহাকুমার সৃষ্টি হয়। মহকুমা বিভক্তির পর জেলার আয়তন দাঁড়ায় যথাক্রমে বালুরঘাট মহকুমা ১১৭৭ বর্গমাইল, ঠাকুরগাঁও মহকুমা ১১৭১ বর্গমাইল এবং সদর মহকুমা ১৫৯৮ বর্গমাইল যা ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগ পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল এবং লোকসংখ্যা ছিল ১৯,২৭,০০।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের রেডক্লিফ এডওয়ার্ড অনুযায়ী দেশ বিভক্তির পরিনামে পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র দিনাজপুর জেলার ব্যাপক আয়তনের রদবদল ঘটে। জেলার ৩০টি থানার মধ্যে সাড়ে ৯টি থানা ভারতের অর্ন্তভূক্ত হয়। সাড়ে ২০টি থানার সাথে বিভাগোত্তর দিনাজপুর জেলায় সংযোজিত হয় জলপাইগুড়ি থেকে বিছিন্ন হয়ে আসা আরও চারটি থানা-দেবীগঞ্জ, বোদা, তেতুলিয়া ও পঞ্চগড়। অল্প কিছুদিন পর পোরশা, পত্নীতলা, ধামুরহাট থানা প্রশাসনিক সুবিধার্থে দিনাজপুর থেকে বিছিন্ন হয়ে রাজশাহী জেলায় অর্ন্তভূক্ত হয়। অতঃপর দিনাজপুর জেলার আয়তন দাঁড়ায় দুটি মহকুমার সমন্বয়ে ২৬৯৯ বর্গমাইল যার লোকসংখ্যা আদমশুমারী অনুযায়ী ১৩,৫৪,৪৩২ জন। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারী ঠাকুরগাঁও মহকুমার পাঁচটি থানা নিয়ে পঞ্চগড় একটি আলাদা মহকুমার সৃষ্টি হয় এবং ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে সমস্ত মহকুমা জেলায় উন্নীত হলে সাবেক দিনাজপুর জেলা নিম্নলিখিত আয়তন বিশিষ্টি তিনটি জেলায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। 
জেলার নাম থানার সংখ্যা আয়তন লোকসংখ্যা 
দিনাজপুর ১৩ ১৪৯৪ বর্গমাইল ২২,৬০,১৩১
ঠাকুরগাঁও ৫ ৭০২ বর্গমাইল ১০,১০,৯৪৮
পঞ্চগড় ৫ ৫৪৩ বর্গমাইল৭, ১২,০২৪

দিনাজপুর বরেন্দ্রভূমির প্রাচীন জনপদ হলেও অতি প্রাচীনকালের অধিবাসী সম্পর্কে খুব কম তথ্যই পাওয়া যায়। মুসলিম আমলের তথ্য যা পাওয়া যায় তা বিদেশী পর্যটকদের অত্র অঞ্চল ভ্রমনের বিচ্ছিন্ন কাহিনী থেকে অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে। কোম্পানী আমল থেকেই দিনাজপুর অঞ্চলের প্রয়োজনীয় তথ্য সংগৃহীত আছে। এ কারনেই বৃটিশ আমলের আর্থসামাজিক বিবরণ যত সুনদরভাবে বিশ্লেষন করা যায়, তার আগের ব্যাখ্যা বিবরণী অনুরুপভাবে অনুমান নির্ভর। একটি অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থা গড়ে উঠে গ্রামীণ অর্থনীতি সংগঠন এবং উৎপাদন সম্পর্কের সাথে সংগতি রেখে। আপাতদৃষ্টিতে উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো শতাব্দীর পর শতাব্দী নিরবিচ্ছিন্নভাবে অপরিবর্তিত ছিল বলেই স্বভাবিকভাবে গ্রামীণ সমাজ ছিল স্বাবলম্বী এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ আর উৎপাদনের সীমাবদ্ধতায় চাহিদাও ছিল সীমাবদ্ধ। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবর্তনে দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটে। মোঘল আমলে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলাফল দিনাজপুর অঞ্চলে ততবেশী অনুভূত হয় না। কিন্তু নবাবী আমলে পরোক্ষভাবে এবং ইংরেজ আমলে তা প্রত্যক্ষভাবে অনুভূত হতে থাকে। 
অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে দিনাজপুর অঞ্চলের আয়তন ও লোকসংখ্যার চাপ অন্যান্য জেলা থেকে বেশী না হলেও কর্মসংস্থানের অভাবে বর্ধিত জনগণের চাপ কৃষির উপর পড়েছিল। জেলার ৭০% আবাদী জমির উপর নির্ভরশীল ছিল ৯০% কৃষিজীবি মানুষ। প্রধান ফসল ধান যা সমগ্র বাংলার মধ্যে ছিল সবচেয়ে বেশী। ইক্ষু, সরিষা, আলু, ডাল, তামাক ছিল অর্থকরী ফসল। নীল চাষের জন্য নীলকুঠি গড়ে উঠলেও দক্ষিনবঙ্গের জেলাগুলির মত জনজীবন ততবেশী অত্যাচারিত ছিল না। শিল্প বলতে কিছুই ছিল না একমাত্র ধানকল, তেলকল ছাড়া। কুঠির শিল্পেও তেমন কোন অবদান রাখেনি একমাত্র কিছু এলাকায় তাঁত শিল্প ও অাঁখ মাড়াই ছাড়া। জেলার প্রধান রপ্তানী দ্রব্য ও অর্থকারী ফসল ছিল চাল এবং কিছু পাট যা নৌকাপথে রপ্তানী করা হত জেলার বাইরে। জেলার অধিকাংশ নদ-নদী বর্ষাকালের ৪ মাস ছাড়া বছরের ৮ মাস শুষ্ক থাকত, ফলে জেলার বাইরের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য ছিল সীমিত। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে রেলপথ ও সড়কপথ বিস্তৃতি লাভ করলে ব্যবসা-বাণিজ্যের কিছুটা প্রসার ঘটে। 
জেলার যৎসামান্য উৎপাদিত তুলা, কাঁচা রেশম, বাশেঁর চাটাই, ঝোলা গুড় রপ্তানী পণ্যের মধ্যে অন্যতম এবং নারায়নগঞ্জের সাথে দিনাজপুরের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল সবচেয়ে বেশি। 
রাজা সুকদেব রায় (১৬৪২-১৬৭৭) এর স্মৃতি আজও বহন করছে রাজবাড়ি সংলগ্ন স্বচ্ছ জলে টলটল সুখসাগর নামের দীঘিটি। তিনি জমিদারীর প্রসার ও প্রতিপত্তি ঘটান এবং উত্তর বাংলায় সবচেয়ে বড় জমিদারে পরিণত হন। ফলস্বরুপ মোঘল সম্রাট তাকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৬৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। পরবর্তীতে ৭ম পুরুষ মহারাজা গিরিজানাথ রায় বাহাদুর (১৮৮২-১৯১৯) রাজা জমিদারের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিপত্তি সম্পন্ন প্রভাবশালী ব্যাক্তি ছিলেন। তিনি রাণী মাতা শ্যাম মোহীনি দেবীর দত্তকপুত্র । রাণীমাতার বদান্যতা ছিল কিংবদন্তীতুল্য এবং দানশীলা মহিলা হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। গিরিজানাথ ছিলেন চিরিরবন্দর থানা অন্তর্গত এক গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। দত্তক গ্রহণকালে তার প্রকৃত মাতা-পিতা ও পরিবারের পরিচয় গোপন রাখা হয়েছিল, তা কোনদিন প্রকাশ করা হয়নি। তিনি ১৮৭১-১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত বরাণসীতে বিখ্যাত ‘কুইন্স কলেজ’ এ লেখাপড়া করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত সফলতা ও ক্ষমতার সাথে তার নিকট অগ্রগামীদের তুলনায় জমিদারী পরিচালনা করেছিলেন। তিনি রাণীমাতার ন্যায় দানশীল ছিলেন। গরীব ও প্রয়োজনীয় ব্যাক্তিদের তিনি সব সময় সাহায্য এবং সহযোগিতা করতেন। 
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘মহারাজা বাহাদুর’ খেতাবে তাকে সম্মানিত করা হয়। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তার নামে পরিচিত বিখ্যাত ‘মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুল’ নির্মান করে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি স্কুল কমিটিকে ২০,০০০ টাকা অর্থ প্রদান করেছিলেন। তার নির্দেশে স্কুলটি রংপুর কারমাইকেল কলেজ ভবনের মডেলে আরও সুদৃশ্য করে নির্মান করা হয়েছিল। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ২১ ডিসেম্বর সকাল ৮ ঘটিকায় তিনি মৃত্যুবরণ করেণ। এতে দিনাজপুর এস্টেট একজন দক্ষ প্রশাসককে হারিয়েছিলেন এবং প্রজাগণ হারিয়েছিলেন একজন হ্নদয়বান জমিদারকে। মহারাজা গিরিজানাথ সামন্ত জমিদার হয়েও অশেষগুনের অধিকারী ছিলেন। জনকল্যাণে তিনি দাতব্য চিকিৎসালয়, বিদ্যালয় স্থাপন, ও জনহিতকর কাজ করে যশস্বী হয়ে আছেন। তিনি বিনয়ী, সাদালাপী, মিষ্টভাষী, সহানুভূতিশীল, সংবেদনশীল কষ্ট সহিষ্ণু ও ধর্মপ্রান ব্যাক্তি ছিলেন। প্রজার কাছে নৃপতি ‘রাজর্ষি’ বলে যে কারণে আখ্যায়িত হন মহারাজা গিরিজানাথ সে ধরনের মানুষ ছিলেন। তার এ সব মহৎ গুনের জন্য তিনি বৃটিশ সরকারের কাছ থেকে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে কে.সি.আই.ই উপাধি লাভ করেন। সেজন্য তিনি ‘স্যার গিরিজানাথ’ নামে অভিহিত হন। উল্লেখ করা যেতে পারে মহারাণী শ্যাম মোহণী দেবী যুবরাজ গিরিজানাথের হাতে ১৮৮২ খ্রীষ্টাব্দে দিনাজপুরের রাজকার্য তুলে দেন এবং তিনি ৭২ বছর বয়সে ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দেই মায়াময় পৃথিবী হতে বিদায় নেন। 
মহারাজা গিরিজানাথ শুধু মহৎ ও যোগ্য শাসক ছিলেন না, তিনি একাধারে আধুনিক শিক্ষার পৃষ্ঠপোষক, ক্রীড়ামোদী, নাট্যমোদী, সংগীতানুরাগী ও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। রাজবংশের রাজাদের মধ্যে বিরাট রাজকীয় লাইব্রেরীতে তিনি নিয়মিত সাহিত্য চর্চা করতেন। 
যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত। সাক্ষর মানুষ কখনও পরনির্ভর নয়। আমরা জানি শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড এবং শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। সে দৃষ্টি বিবেচনা করেই বলছি শিক্ষা ব্যবস্থা অপরিহার্য। দিনাজপুরের ইতিহাসে উনবিংশ শতাব্দী হতে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত দিনাজপুরের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন ছিল, তা সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল জানার জন্য। 
রাজা নেপোলিয়ান বোনোপার্ট বলে গেছেন ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দিব’। শিক্ষার উপলব্ধিতে মহারাজা গিরিজানাথ মনে করেছিলেন জ্ঞানী ব্যাক্তি কখনও সহজে ভুল করতে পারেন না। সাক্ষর ও জ্ঞানী ব্যক্তিকে প্রতারিত করা যায় না এবং শিক্ষিত ব্যক্তি জাতিকে অনেক কিছু দিতে পারে। তাই তিনি শিক্ষার প্রতি অনুরাগী হয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘মহারাজা গিরিজানাথ রায় হাই স্কুল’। এমনি করে উনবিংশ শতাব্দীতে দিনাজপুরের স্থানীয় কৃষক ও প্রজাদেরকে ও সভ্যতার আলোকদান করার জন্য স্কুল, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। 
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মিশনারীরা শিক্ষা প্রদানের কাজ সূচনা করেন। ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে এদেশে কি ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে তা নিয়ে শিক্ষানীতি প্রণেতারা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়। এ পক্ষের যুক্তি ছিল সংস্কৃত ও আরবী ভাষার প্রচলনে শ্রীবৃদ্ধি সাধনের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা এবং অন্যপক্ষের অনুসারীদের যুক্তি অবতীর্ণ করেন- ইংরেজ ভাষায় ইউরোপিয় জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি সাধন করা। যখন উভয় পক্ষের যুক্তি প্রদর্শন করে বাদানুবাদ তুঙ্গে তখন লর্ড মেকলে ভারতীয় আইন সভার সদস্য হিসেবে ভারতে পদার্পণ করে শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন। তিনি দেশীয় ভাষা বিশেষ করে আরবী ও সংস্কৃত ভাষায় শিক্ষা বিস্তারে চরম আপত্তি প্রকাশ করেন। এ দুই ভাষায় বই মুদ্র